Table of Content
- From Editorial Desk : Rituraj Banerjee
- হৃদি-গঙ্গার উৎসমুখে (পর্ব-১৫): শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়
- অন্য পথে কেদার (পর্ব ১): মৈনাক কর্মকার
- কারাকোরাম কন্যা- তুর্তুক: লোপামুদ্রা বর্মন
- স্বর্গোদ্যানের পথে – The Valley of Flowers : Shankha Sanyal
- Mountains in Illustration : Abhinanda Chowdhury
- Tales from Wild: Common Tailorbird : Soumyo Chatterjee
From Editorial Desk
Rituraj Banerjee
We remember, in this edition of Bohemian Travelogue, the legendary mountaineer, Marty Schmidt, the New Zealand – American mountain climber who succumbed to death on 27th July, 2013,along with his son Denali, by an avalanche inside their tent, while attempting to climb Mt K2. He was born in California, in 1960, but later moved to New Zealand. At the age of 20, Schmidt joined the United States Air Force (USAF) and served in the United States Air Force Pararescue unit. Schmidt climbed and guided in the mountains of Europe, South America, Africa and the Himalayas. In the Himalayas, Schmidt attempted to climb Mount Everest in 1994 and 2008. He summited Kangchenjunga in 2001, and summited Cho Oyu in 2001, 2004 and 2009.
This edition of Bohemian Travelogue brings to our readers the 15th and final installment of “হৃদি-গঙ্গার উৎসমুখে” – in search of the mighty Ganges. A long journey in search of the origin of the river Bhagirathi associated with spirituality, history and mythology, finally comes to an end with a feeling a sorrow drenched with mysticism.
There is also a story of trekking in the heavenly ‘Valley of flowers’ in Uttarakhand. The author has shared his unique experience of trekking through some of the rarest flowers, breathtaking views amidst rivers, mountains and meadows. We also bring to our readers, the experience of trekking through a new route to the mythologically significant temple of Kedarnath.
In another article, the author has taken us, along with her, to one of the northernmost villages of India, second only to Murgo village. She has shared some of her unique experiences in the remote village of Turtuk, in the Ladakh Union Territory. The author has documented, in her brilliant writing skills, the picturesque landscape, the culture and traditions of the hard working but simple people of the village.
Further we bring, as we always have, “Tales from the Wild” – the kingdom of wildlife and birds. Author has documented brilliantly the details of ‘Common Tailor Bird’ in this article.
This is Rituraj Banerjee, editor of Bohemian Travelogue, signing off. I wish you, our esteemed readers and writers, that which is all there is to wish anyone anymore: sound health and happiness in this troubled time. Thank you and bye-bye.
**********************************
হৃদি-গঙ্গার উৎসমুখে (পর্ব-১৫)
শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়
Bioinorganic Chemist, Author, Traveller, Hyderabad
ভোররাতের দিকে ঘুম ভাঙল। সন্তোষদা ডাকছে। কী ব্যাপার? না প্রকৃতির ডাক এসেছে। অগত্যা জোড়া লেপের ওম ছেড়ে হি হি করতে করতে এসে দাঁড়ালাম কুঠিয়ার বাইরে। কিন্তু যার ডাকে বাইরে এলাম সে কোথায়? আশ্রম থেকে খানিক দূরে একটা পাথরের আড়াল থেকে তার সাড়া পাওয়া গেল। গলার স্বর জানান দিচ্ছে যে, এই সাঙ্ঘাতিক ঠাণ্ডায় শৌচে যাওয়া রীতিমত যুদ্ধে যাওয়ার সামিল। কিন্তু উপায়ই বা কী?
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে, আশ্রমের প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে থাকি৷ তখন চাঁদ অস্ত গিয়েছে। ভোরের আলো ফুটতেও দেরি আছে। তবু কী এক স্নিগ্ধ আলোয় তপোবন ভরে আছে। এ আলো কোথা থেকে এলো? আকাশের দিকে তাকাতে এক অবাক বিস্ময়ে মন পরিপূর্ণ হয়ে গেল। গ্রামের ছেলে, তাই অন্ধকার রাতে তারায় ভরা আকাশের দৃশ্য আমার কাছে নতুন নয়। তবু, এ দৃশ্য যে কখনও দেখিনি, তাতে সন্দেহ নেই। মাথার উপর সুবিশাল এক অবতল আয়নার মত আকাশ। কী ভীষণ স্বচ্ছ সে আয়না। আর তার বুকে দ্যূতিমান রত্নরাজির মত গাঁথা রয়েছে অজস্র, অগণিত নক্ষত্র। এত নক্ষত্র একসাথে আমি সত্যিই কখনও দেখিনি। তাদের মৃদু আলোর আভায় শিবলিঙ্গের বরফে ঢাকা চূড়া ভাস্বর। অগণিত সেই নক্ষত্রের আলো, আর হিমরাশি থেকে প্রতিফলিত আলো – এই দুইয়ের মিলনে ফিকে হয়েছে রাত্রির অন্ধকার। কুসুম কুসুম আলোয় চারিদিক মাখামাখি। ভাগ্যিস ঘুম ভেঙেছিল, ভাগ্যিস দাদা ডেকেছিল।
দ্বিতীয় দফার ঘুমটা একটু বেশিই গাঢ় হয়ে গিয়েছিল। চোখ মেললাম, তখন সাতটা বাজে। দিনের প্রথম আলোর ছোঁয়া লেগে শিবলিঙ্গের চূড়া সোনা হয়ে যায়, সে দৃশ্য আর দেখা হল না। কৃষ্ণর ভোরবেলা ওঠা অভ্যাস। কথা ছিল সে আমাদের ডেকে তুলবে। বেচারি আজ নিজেও ঘুমিয়ে গিয়েছে। কী আর করা যাবে। ক্যামেরা হাতে বাইরে এসে দাঁড়াই। ততক্ষণে শিবলিঙ্গের গা বেয়ে নরম রোদ গড়িয়ে পড়েছে অনেকখানি। যদিও উপত্যকা তখনও নীলচে ছায়ায় ঢাকা।
পুবদিকে ভাগিরথীর তিন শিখর। তাদের পিছন দিক থেকে সূর্য উঠছে। রোদ ঝলমল আকাশে তিনটি চূড়ার ছায়া অপসারী ছটা এঁকে বহুদূর অবধি ছুটে গিয়েছে। ভারি আশ্চর্য সে ছবি। শিবলিঙ্গ চূড়ার ঠিক ডানপাশে ঝকঝক করছে মেরু পর্বত। মেঘের আনাগোণায় কাল সারাদিনে একবারও তাকে ভালোভাবে দেখা যায়নি। এখন আশ মিটিয়ে দেখে নেওয়ার পালা। মেরু পর্বত বেশ অদ্ভুতদর্শন। সচরাচর এমন দেখা যায় না। যেন বিশাল একটি ত্রিমাত্রিক ট্রাপিজিয়াম। তার উপরের তলটি ভাগ হয়ে তিনটি চূড়ার জন্ম দিয়েছে। দক্ষিণের চূড়াটি সবচেয়ে উঁচু (২১৮৫০ ফুট), শিবলিঙ্গের দিকে থাকা উত্তর চূড়াটি তারপরে (২১১৬০ ফুট)। মাঝের চূড়াটি সবচেয়ে কম উঁচু (২০৭০০ ফুট)। উচ্চতায় কেউকেটা না হলেও মেরু পর্বতের মাঝের চূড়াটি হিমালয়ের সবেচেয়ে বিখ্যাত চূড়াগুলির মধ্যে একটি। এই মাঝের চূড়া বা মেরু সেন্ট্রাল সামিটের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে পাথরের একটি খাড়া দেওয়াল রয়েছে। ঠিক হাঙরের পাখনার মত দেখতে সেই দেওয়ালটির নাম Shark’s fin. এই শার্ক’স ফিন দেওয়াল টপকে মেরু সেন্ট্রাল শৃঙ্গটিকে জয় করা এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত অসম্ভব বলে মনে করা হত। বছরের পর বছর কত না পর্বতারোহী এই অসাধ্যসাধনের জন্য ছুটে এসেছেন মেরুর পাদদেশে। সাফল্য আসেনি। অবশেষে ২০১১ সালে কনরার্ড অ্যাঙ্কার, জিমি সিন, ও রেনান ওজটুর্ক জয় করেন মেরু সেন্ট্রাল সামিট। হাঙরের পাখনা হেরে যায় মানুষের অদম্য জেদের কাছে। পর্বতারোহণের সময়েই জিমি সিন তাঁর নিজের ক্যামেরায় এই অনন্য অভিযানের মুহূর্তগুলোকে ধরে রেখেছিলেন। ২০১৫ সালে সেগুলিকে সাজিয়ে তিনি বানিয়ে ফেলেন অমূল্য এক তথ্যচিত্র – মেরু। যাঁরা হিমালয়কে ভালোবাসেন, তাঁরা সুযোগ পেলে একবার অন্তত এই তথ্যচিত্রটি দেখতে পারেন। সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে।
মেরু পর্বতের ডানদিকে মেরু বামাক হিমবাহের গ্রাবরেখা, সুউচ্চ প্রাচীরের মত ঘিরে রেখেছে তপোবনের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত। তার পিছনে চিনার পাতার আগার মত তিনটি চূড়া নিয়ে ভৃগু পাহাড় (ভৃগুপন্থ নয়)। আরও ডানদিকে তাকালে গঙ্গোত্রী হিমবাহের ওপারে সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে চেনা-অচেনা কত না শৃঙ্গরাজি। তাদের মধ্যে একটির চূড়া ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। খানিক বরফের ছোঁয়া আছে বটে, তবে বেশিরভাগটাই অনাবৃত কালো পাথর। ওটি থেলু (১৯৭০০ ফুট)। থেলুর ঠিক বাঁদিকে পিরামিড আকৃতির তুষারশৃঙ্গ। নাম মৈত্রী (২২০৫১ ফুট)। থেলুর ডানপাশে আমাদের চিরপরিচিত সুদর্শন পর্বত (২১৪২১ ফুট)। গঙ্গোত্রী থেকে যখন সুদর্শনকে দেখেছিলাম তখন সে ছিল আমাদের দক্ষিণ-পূর্বদিকে। এখন সুদর্শন আমাদের উত্তর-পশ্চিমে। তবু তাকে চিনতে অসুবিধা হয় না। সুদর্শন, থেলু, ও মৈত্রী ছাড়াও তাদের আশেপাশে সৈফী ও চতুর্ভূজ পর্বতকে দেখতে পাওয়ার কথা। যদিও অজস্র চূড়ার ভিতরে তাদের চিনতে পারলাম না।
মৌনীবাবার আশ্রমের সামনে বিরাট একটি পাথর। তার উপরে রোদ এসেছে। পাথরে বসে রোদ পোহাচ্ছি আর পাহাড় দেখছি। অখিলেশ আশ্রম থেকে চা এনেছে। স্টিলের গ্লাসে গরম চা। চা খেয়ে গলার আরাম, চায়ের গ্লাস ধরে হাতের আরাম। সৌরভ চা দেখেই আঁতকে উঠে বলল – চা খাব না!
কেন খাবিনা?
চা খেলে গ্লাস ধুতে হবে। এই ঠাণ্ডায় আমি জল ঘাঁটতে পারব না।
আমরা বাকরুদ্ধ!
চা টা খেয়ে, আকাশগঙ্গার তীর বরাবর কৃষ্ণ চলে গেল শিবলিঙ্গের পাদদেশে। কাল বিকালে শরীর খারাপ থাকায় ও আমাদের সঙ্গে যেতে পারেনি। আজ শরীর চাঙ্গা। তাই শিবলিঙ্গ ছুঁয়ে আসা চাই। আমরা পাথরে বসে বসে দেখতে থাকলাম কৃষ্ণর লাল জ্যাকেট ছোট হতে হতে কখন বিস্তীর্ণ তৃণভূমির মধ্যে হারিয়ে গেল।
আশ্রম প্রাঙ্গনে ঝাঁক ঝাঁক পাখি এসেছে। খানিকটা কাকের মত দেখতে, যদিও ঠোঁটটা ময়নার মত হলুদ। এই পাখি গাড়োয়াল হিমালয়ের অনেক জায়গাতেই দেখা যায়। কেদারনাথ, ও বদ্রীনাথে দেখেছি। এদের নাম অ্যালপাইন চাফ (alpine chough)। পাখি দেখে খেয়াল হল আসার সময় দু’দিনে বন্যপ্রাণের দেখা পাইনি সেভাবে। গঙ্গোত্রী ন্যাশানাল পার্কে প্রায়শই ভড়াল (blue sheep) দেখা যায়। আমাদের কপাল নেহাতই মন্দ। না হলে একটাও ভড়াল চোখে পড়বে না কেন!
কথা ছিল আজ তপোবন নেমে ভুজবাসা বা চীরবাসায় রাত্রিবাস করব। কাল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গঙ্গোত্রী ফিরে গিয়ে সোজা হরিদ্বারের পথে৷ সমীর বলল সকাল সকাল নামতে শুরু করলে হয় না? তাহলে আজই গঙ্গোত্রী ফিরে যাওয়া যাবে। দেখা গেল বাকিদেরও তাতেই সায়। সত্যি বলতে কী আজ রাতে ভুজবাসায় থাকলে কাল প্রায় ১৫-১৬ কিলোমিটার হেঁটে গঙ্গোত্রীতে নামতে হবে, আর নেমেই গাড়ি ধরতে হবে। সেদিক থেকে চীরবাসায় থাকা সুবিধাজনক। সমস্যা এই যে চীরবাসায় রাত কাটানোর ব্যবস্থাপনা মোটেই সন্তোষজনক নয়। কাজেই অন্দর হিমালয়ের কোলে আরও একটা রাত কাটাতে ইচ্ছা করলেও বেশ বুঝতে পারছি গঙ্গোত্রী ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। সন্তোষদা জিজ্ঞাসা করল
এখনই বেরিয়ে পড়লে হয় না? ব্রেকফাস্ট না হয় ভুজবাসায় করে নেব।
অখিলেশ রাজি নয়৷ এখনও নদীর উপত্যকায় রোদ নামেনি। কাজেই নদীর উপরে জেগে থাকা পাথরের মাথায় জমে থাকা বরফ গলেনি। এই অবস্থায় নদী পার হওয়া বিপদজনক। আরও অন্ততঃ এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।
ঘড়ির কাঁটা দ্রুত ছুটে চলে। দূর তৃণভূমিতে আবার একটা সঞ্চরণশীল বিন্দু দেখা যায়। কৃষ্ণ ফিরছে। ওদিকে মৌনীবাবার কাছ থেকেও ডাক এসেছে। নাস্তা রেডি।
আশ্রমের বাইরে কিছুটা সমতল জায়গা। সেখানে শতরঞ্চি বিছানো হয়েছে৷ এ বেলা খোলা আকাশের নীচেই খাওয়াদাওয়া। গোল হয়ে বসে পড়লাম। আমরা পাঁচজন, বড়বাবু-ছোটবাবু, অখিলেশ-মুখিয়াজী, অন্যদু’টি ঘরে থাকা অতিথিরা – সবাই একসঙ্গে। গরম আলুর পরোটা, আচার আর চা। মাথায় পাগড়ি বেঁধে পরিবেশন করছেন মৌনীবাবা। সেই হাসি মুখ, সেই আন্তরিকতা। আলাপ হল অন্য অতিথিদের সঙ্গেও। দু’জন অল্পবয়সী ছেলে। আমাদের ছেয়ে বেশ কয়েক বছরের ছোট। কাল বিকালে তপোবনে এসে পৌঁছেছে। ওরা শিবপুরে ইঞ্জিয়ারিং পড়ে। সঙ্গে করে মৌনীবাবার জন্য একটি সোলার লন্ঠন এনেছে। তাদের সঙ্গে এটাসেটা গল্প জমে উঠল। গল্প জমে উঠল মাঝবয়সী এক বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে। চাকুরিজীবী মানুষ। অকৃতদার। কাল দুপুরে এসেছেন। এখন দু’দিন থাকবেন তপোবনে। প্রতিবছরই পাহাড়ে বেশকিছু দিন কাটিয়ে যান। গতবারে গিয়েছিলেন হর কি দুন উপত্যকা। সোনারপুরবাসী এই শান্তশিষ্ট মানুষটির প্রতি মনে মনে শ্রদ্ধাবোধ জাগে, সামান্য ঈর্ষাও।
তৃপ্তপ্রাণ একদল মানুষের কলতানে মুখর হয়ে ওঠে মৌনীবাবার বাহির-বৈঠকখানা। চারিদিকে ঘিরে থাকা তুঙ্গ হিমালয়ের শিখরেরা সেই আনন্দ আলাপের সাক্ষী থাকে। সময় ফুরিয়ে আসে। শিবলিঙ্গকে পটভূমিতে রেখে গ্রুপ ফটো তোলা হয়। প্রণামান্তে মৌনীবাবাকে জানাই – ইচ্ছা রইল আবার আসব কখনও। তারপর ব্যাগপত্তর পিঠে ঝুলিয়ে রওনা দেওয়ার পালা। ঘড়িতে তখন পৌনে ন’টা।
আকাশগঙ্গা থেকে বোতলে জল ভরে নিতে হবে। কারণ নদী পার হওয়ার আগে পথে আর কোনো ঝরনা পড়বে না। কিন্তু জল ভরব কীভাবে। আকাশগঙ্গার তো জমে বরফ। শেষে পাথর ঠুকে বরফের চাদর ভেঙে জল নেওয়া গেল। তারপর হাঁটা শুরু।
একটানা হেঁটে পৌঁছে যাই তপোবনের প্রান্তে। উৎরাই শুরুর আগে শেষবারের মত দেখে নিই তপোবনকে। ঝকঝকে নীল আকাশের নীচে ঝলমল করছে শ্বেতশুভ্র শিবলিঙ্গ। ঝলমল করছে তাম্রাভ মেরু পর্বত। শিবলিঙ্গের বাঁদিকে অনেকটা দূরে আরও একটি তুষারশৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। মাউন্ট খরচাকুণ্ড (২১৬৯২ ফুট)। খরচাকুণ্ড শৃঙ্গটিকে আগেও দেখেছি। তুঙ্গনাথ অঞ্চল থেকে কেদারনাথ রেঞ্জের পাশে সুমেরু পর্বতের ঠিক পিছনে এই শৃঙ্গকে দেখা যায়। যদিও তুঙ্গনাথ থেকে দেখা যায় খরচাকুণ্ডের দক্ষিণমুখ, আর তপোবন থেকে দেখা যায় উত্তর মুখ। দু’দিক থেকে শৃঙ্গটিকে সম্পূর্ণ আলাদা রকম দেখতে। খরচাকুণ্ড আর শিবলিঙ্গ, এই দুই শৃঙ্গের ঠিক মাঝখানে আছে আর এক বিখ্যাত শিখর, কেদারডোম। যদিও শিবলিঙ্গের পূর্বঢালের আড়াল পড়ায় তপোবন থেকে তাকে দেখা যায় না। কেদারডোমের অন্যদিকে শিবতীর্থ কেদারনাথ। অর্থাৎ মাঝখানে পাহাড়ের প্রাচীরটুকু বাদ দিলে কেদারনাথ আর তপোবনের মধ্যে দূরত্ব সামান্যই।
শেষ মুহূর্তেও ঝপঝপ্ ওঠানামা করছে ক্যামেরার শাটার৷ আর তো কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র, তার আগে এই স্বর্গপুরীর আলো যতটুকু ধরে রাখা যায়। তাড়া দেয় অখিলেশ। বেলা বাড়লে নদীতে জল বাড়বে। তখন নদী পার হওয়া মুশকিল হবে। এ এক বিচিত্র সমস্যা। ভোর ভোর রওনা দিলে পাথরের মাথায় বরফ জমে থাকবে, তাই নদী পার হওয়া বিপদজনক। আবার বেলা বাড়লে নদীর জল বাড়বে, তখনও নদী পার হওয়া বিপদজনক। দু’দিক সামলে নিরাপদে নদী পার হতে তাই গাইডের ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। গাইডের কথামত আর দেরি না করে পা চালাই। বিদায় তপোবন, বিদায় স্বর্গভূমি।
উৎরাই। শ্বাসবায়ু হাতড়াতে হাতড়াতে কাল দুপুরে যে পথে উঠে এসেছিলাম, আজ সেই পথ ধরেই নেমে যাওয়ার পালা। সেই সত্তর ডিগ্রী খাড়া, ঝুরঝুরে মাটি-পাথরের দেওয়াল। নীচ থেকে তপোবনের চড়াই দেখে যেমন বুক শুকিয়ে গিয়েছিল, উপর থেকে নীচের দিকে তাকাতেও তেমনই বুক শুকিয়ে এল। প্রায় বারো-চোদ্দ’শ ফুট নীচে গঙ্গোত্রী হিমবাহের উপরিভাগ, ধুলোমাটিতে ঢাকা। এই অতখানি পথ নামতে হবে ঢিলা পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে। ভয় যে একটু লাগছে না, তা নয়। তবে এরইমধ্যে সৌরভ গব্বর সিংয়ের গলায় বলে দিয়েছে – যো ডর গয়া, সমঝো মর গয়া! ভীষণ সত্যি। এই পথে ভয় পেলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না।
ধীরে ধীরে নামতে শুরু করি। সামনে সামনে চলে অখিলেশ। কোন পাথর ঢিলা, কোনটি শক্ত, কোনটিতে পা রাখলে গড়িয়ে পড়ব না, এসব আমাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল। চুপচাপ অখিলেশকে অনুসরণ করি। একে একে পাঁচজন। যে জায়গাগুলো খাড়াই বেশি সেখানে চার হাত-পায়ে নামি। এমনকী স্থান বিশেষে বসে বসেই নামি। তাড়াহুড়ো করলে বিপদ, পা হড়কাবে। ঢিমেতালে নামলেও বিপদ, ওপর থেকে পাথর গড়াবে। প্রায় একঘণ্টা ধরে ধীরে ধীরে নেমে এলাম একদম হিমবাহের কিনারায়।
বড়বাবু আর ছোটবাবু খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। তাদের সঙ্গে তাল রেখে পিছিয়ে পড়েছেন মুখিয়াজীও। উৎরাই শেষে যে জায়গায় গঙ্গোত্রী হিমবাহের প্রান্তভাগে মেরু বামাক হিমবাহ এসে মিশেছে, সেখানে এসে আমরা দাঁড়াই। ওই তো ওরা নামছে। আসুক, তারপর একসঙ্গে যাওয়া যাবে। ঠিক এই সময় আচমকা অখিলেশ চিৎকার করে ওঠে – ভাগো! ভাগো!!
আমরা চমকে উঠি। কী হয়েছে? পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ততক্ষণে দৌড়াতে শুরু করেছেন মুখিয়াজী। একহাতে বড়বাবুর হাত ধরেছেন, অন্যহাতে ছোটবাবুর হাত। প্রাণপণে দুজনকে প্রায় হিঁচড়ে নিয়ে ছুটছেন মুখিয়াজী। আর ওপর থেকে টকটক শব্দ করে নেমে আসছে অজস্র পাথরের টুকরো। প্রতি মুহূর্তে তাদের গতি বাড়ছে। প্রতি মুহূর্তে তাদের ধাক্কায় খসে পড়ছে আরও ছোটবড় পাথরের টুকরো। রুদ্ধশ্বাস কয়েকটা মিনিট৷ আপাত নির্বিঘ্ন যাত্রায় এই বুঝি মৃত্যুর দাগ লেগে গেল। কিন্তু না। একসময় পাথর গড়ানো থামল। দু’জনকে নিয়ে নিরাপদে নেমে এলেন মুখিয়াজী। ছোটবাবু দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল অখিলেশকে। ভাগ্যিস তুমি দেখেছিলে!
ঘটনার আকস্মিকতা কাটলে আবার পথ চলা শুরু হয়। মেরু বামাক হিমবাহ পার হয়ে বোল্ডারের রাজ্য। তারপর ভাগিরথী। নদী পার হয়ে আমরা যাব উত্তরতটে। পাথরের উপর বসে আমরা খানিক জিরিয়ে নিলাম। অখিলেশ ততক্ষণে নদীতে নেমে পড়েছে। নদীর বুকে জেগে থাকা বড় পাথরগুলোর মাথায় মাথায় বরফের পুরু চাদর। লাঠি দিয়ে ঠুকে ঠুকে সেগুলোকে ভেঙে দিচ্ছে অখিলেশ। একটানা নদী পার হওয়া সম্ভব নয়। কাজেই মাঝামাঝি দুটো বড়সড় পাথরকে বেছে নেওয়া হয়েছে। নদীর এ পার থেকে দলবেঁধে প্রথমে সেই পাথরে গিয়ে উঠব। তারপর আর এক খেপে নদীর ওপারে। কালকের চেয়ে জলের স্রোত আজ অনেকটাই বেশি। তাই একা একা জলে নামব না। পরস্পরের হাত ধরে মানব শৃঙ্খল তৈরী করে পার হব। ন’জন ভাগ হয়ে গেলাম দু’টি দলে। প্রথম দলে অখিলেশ, সন্তোষদা, সমীর আমি আর সৌরভ। দ্বিতীয় দলে বাকিরা। দুগগা দুগগা বলে নেমে পড়লাম জলে। নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেলাম মাঝখানের পাথরে। তারপর আবার জলে নামা। বিপদ ঘটল সেখানেই। জলের ভিতরে ছিল আলগা পাথর। তাতে পা পড়তেই হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম জলে। ভাগিরথীর প্রবল স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, অন্যদিকে প্রাণপনে টেনে রেখেছে বন্ধুদের হাত। দ্বিমুখী টানাটানির মধ্যে কয়েকটা সেকেন্ড মাত্র। আবার উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। হিমবাহ গলা জলে আমার বুক পর্যন্ত ভিজে চুপচুপ করছে। দোসর হয়েছে কনকনে হাওয়া। গোটা শরীর হি হি করে কাঁপছে।
কিন্তু দ্বিতীয় দল জলে নামছে না কেন? কখন পার হবে ওরা? বোঝা গেল সমস্যা গভীর। মানব শৃঙ্খল করে নদী পার হওয়াটা বড়বাবুর পছন্দ নয়। সে চোখ রাঙাচ্ছে মুখিয়াজীকে – তুমি আমার গাইড। আমাকে আলাদা করে ধরে ধরে পার করে দিতে হবে। এটা তোমার কর্তব্য। মুখিয়াজী যতই বোঝান বড়বাবু বুঝবেন না। বেশ খানিকক্ষণ বিতণ্ডার পর কৃষ্ণ আর ছোটবাবু নিজেরাই পার হয়ে চলে এল এপারে। বড়বাবুকে নিয়ে মুখিয়াজী তখনও অথৈ জলে।
ছোটবাবুর ব্যাগে ছিল খাঁটি চাকভাঙা মধু। কাঁপতে দেখে, তার খানিকটা খাইয়ে দিল আমাকে। মিনিটখানেকের মধ্যে কাঁপুনি বন্ধ। ততক্ষণে বড়বাবুও চলে এসেছে এ পারে। আর আসতেই তুলকালাম। কোনো কারণে তার মনে হয়েছে ছোটবাবু আমাদের দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাকে হেনস্থা করছে। সে কেন আগেভাগে নদী পার হল, সে কেন আমাদের সঙ্গে মধু ভাগ করল? ছোটবাবুর উপর সেকী চোটপাট! এদিকে ছোটবাবু যতই ঠাণ্ডা মাথার মানুষ হোক না কেন, একতরফা শুনতে কারই বা ভালো লাগে। সেও দু’চার কথা পালটি দিতে শুরু করছে। মাঝখান থেকে আমাদের রীতিমত হতভম্ব দশা। বড়বাবুর হলটা কী? মাথায় অক্সিজেন কম যাচ্ছে? নাকি পাথর গড়ানোর সময় ভয় পেয়ে গিয়ে মাথা ঠিক কাজ করছে না? কারণ যাইহোক না কেন এ অবস্থায় তার সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। বুঝিয়ে শুনিয়ে ছোটবাবুকে নিয়ে আমরা রওনা দিলাম ভুজবাসার পথে। মুখিয়াজী রয়ে গেলেন। বড়বাবুর রাগ পড়লে তাকে নিয়ে তিনি নামবেন।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে গোমুখ। মনের মধ্যে একটা ছোট্ট খেদ, যাওয়ার আসার পথে গোমুখ দেখলাম বটে, তবে দূর থেকেই। কাছে গিয়ে গোমুখ দর্শন এ যাত্রায় আর হল না। মা গঙ্গার ইচ্ছা হলে আবার আসব কোনোদিন। ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলি ভুজবাসার দিকে। প্রথম দু’কিলোমিটার কোনো সুনির্দিষ্ট রাস্তা নেই। চারিদিকে অজস্র বোল্ডার। তার মাঝে মাঝে পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে পথ নির্দেশ দেওয়া আছে। তাই দেখে পথ চলি। হঠাৎই কৃষ্ণ চিৎকার করে – হরিণ, হরিণ!
হরিণ নয়, ভড়াল। নদীর ওপারে বালির চরায় তিনটি ভড়াল। হয়ত জল খেতে এসেছে। দূর থেকেই তাদের ক্যামেরাবন্দী করে আবার এগিয়ে যাই। বেলা ১২টা নাগাদ পৌঁছাই ভুজবাসা। অর্ধবৃত্তাকার পথে পাহাড়ের গা ছুঁয়ে মূল রাস্তা চলে গিয়েছে চীরবাসার দিকে। অপেক্ষাকৃত সরু একটি পথ নেমে গিয়েছে নদীর দিকে। সেদিকে দেখা যাচ্ছে লালবাবার আশ্রম। দেখা যাচ্ছে GMVN গেস্ট হাউস। যেখানে পরশু রাতে আশ্রয় পেয়েছিলাম আমরা।
পথের ধারে একটা পাথরের উপর বসে পড়ি। সামনে অনেকটা পথ। দুপুরের খাবার মিলবে সেই চীরবাসায়। তাই যার কাছে যা ছিল – কেক, বিস্কিট, মিষ্টি – তাই দিয়ে সেরে নিই পেটপুজো। তারপর আবার পথচলা। অখিলেশ ভুজবাসাতেই থেকে যায়। বড়বাবু আর মুখিয়াজী এখনও এসে পৌঁছাননি। ঠিক হয় ওরা এসে পৌঁছালে অখিলেশ রওনা দেবে এবং চীরবাসা পৌঁছানোর আগেই আমাদের ধরে ফেলবে। সেইমত আমরা পাঁচজন রওনা দিই চীরবাসার পথে। ছোটবাবুও আমাদের সঙ্গ নেয়।
ছয় কিলোমিটার পথ। ঘণ্টা দেড়েকের বেশি লাগবে না। ফিরতি পথ, চেনা পথ। গল্প করতে করতে ধীরে সুস্থে চলি। কৃষ্ণ আর সমীর খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝেই পাহাড়ের আড়ালে ওরা হারিয়ে যাচ্ছে। সৌরভের হাতে ক্যামেরা। কাজেই সে সবার পিছনে। এক সময় পাহাড়ের একটা বাঁক পার হতেই দেখি সমীর আর কৃষ্ণ প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে৷ চোখমুখ দেখে বোঝা যায় ভয় পেয়েছে। কী ব্যাপার?
ব্যাপার আর কিছু নয়। গিলা পাহাড়। ভুজবাসার পর থেকেই শুরু হয়েছে ঢিলা পাথরের ধসপ্রবণ পাহাড়, অর্থাৎ গিলা পাহাড়। গিলা পাহাড় পার হওয়ার সময় কৃষ্ণ যাচ্ছিল আগে আগে, সমীর পিছনে পিছনে। দু’জনের মধ্যে হাত বিশেকের দূরত্ব। এমন সময় হঠাৎই, দু’জনের ঠিক মাঝখানে ওপর থেকে গড়িয়ে এসেছে প্রকাণ্ড একটি পাথরের চাঁই। অল্পের জন্য বিপদ ঘটেনি। পাথরটি কয়েক সেকেন্ড আগে পড়লে কৃষ্ণ থেঁতলে যেত, কয়েক সেকেন্ড পরে পড়লে সমীর। বুঝলাম দল ভেঙে আগেপরে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। কপালে বিপদ থাকলে থাকুক, কিন্তু একসঙ্গে থাকাটা জরুরি।
যতটা সম্ভব সাবধানে একে একে পার হয়ে গেলাম দু’টি গিলা পাহাড়। দূর থেকে দেখা যায় চীরবাসার জঙ্গল। কিন্তু অখিলেশ তো এখনও এল না? সে না আসুক। বেশ খিদে পেয়েছে। আগে তো চীরবাসায় পৌঁছাই৷
চীরবাসায় পৌঁছালাম বেলা দেড়টায়। ত্রিপলে ছাওয়া দোকানঘরে চা ফুটছে। অনেক যাত্রী ভুজবাসার দিকে রওনা দেওয়ার আগে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। গরম চায়ে একটু গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন।
দোকানে খোঁজ নেওয়া হল – রোটি, পরাঠা মিলেগা না ভাইয়া?
গ্লাসে চা ঢালতে ঢালতে দোকানের ছেলেটি জানাল – না, রুটি পরোটা কিছুই পাওয়া যাবে না।
কেন পাওয়া যাবে না? – না যে পরোটা বানায় তার তবিয়ত খারাপ। সে আজ আসেনি।
সর্বনাশ। তবে খাব কী?
শুধু চা আর বিস্কিট পাওয়া যাবে। উপায় যখন নেই তখন তাই খেয়েই খিদে মেটাতে হবে। মুখিয়াজীর কাছে আমাদের একটা ব্যাগ আছে, তাতে চিঁড়েভাজার প্যাকেট আছে। কিন্তু কোথায় মুখিয়াজী, কোথায়ই বা অখিলেশ৷ গজগজ করতে করতে চা বিস্কিট খেয়ে খিদে মেটালাম। তারপর অখিলেশদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কেন এত সময় লাগছে ওদের?
ছোটবাবু বড়বাবুর উপর তখনও বেশ বিরক্ত। বলল – দেখো গিয়ে ভুজবাসায় লাঞ্চ সেরে আসছে। ওই লোকটাকে কোনো বিশ্বাস নেই৷
সম্পর্কে বড়বাবু হল ছোটবাবুর বস। অফিসে নানা ছোটখাটো বিষয়ে কেমন ভাবে বড়বাবু তাকে হেনস্তা করে সেই সব বলতে বলতেই একসময় ছোটবাবু বলে ফেলল – ওর চাকরি আমি ছেড়ে দেব!
-ছেড়ে দেবে মানে? চাকরি ছেড়ে করবে কী?
-আর একটা চাকরি পেয়ে গেছি। ট্রেনের মোটরম্যানের চাকরি। ভেবেছি কলকাতায় ফিরেই এই চাকরিটায় ইস্তফা দেব।
-তোমার বস জানে?
-না, না। এখন কেউ জানায়? জানতে পারলে পাহাড়ে ঘোরার মেজাজটাই মাটি করে দিত। এমনিতেই কেমন ব্যবহার করে দেখছ তো।
প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও যখন অখিলেশরা এল না, তখন সবাই মিলে ঠিক করা হল আর নয়। সওয়া দু’টো বাজে। এখন রওনা না দিলে গঙ্গোত্রী পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। সেইমত আবার শুরু হয় পথচলা।
চীরবাসা পার হতেই দেখা যায় নীচে, গঙ্গোত্রীর দিকে ঘন কালো মেঘ জমেছে। রওনা তো দিয়ে দিলাম। এখন যদি বৃষ্টি নামে? আমাদের সবার রেনকোট মুখিয়াজীর ব্যাগে। নিজেরা তো ভিজবই, ক্যামেরা, ফোন সব ভিজে যাবে। অখিলেশ আর মুখিয়াজীর উপর বেশ রাগই হল৷ তোমরা আমাদের গাইড আর পোর্টার। আমাদের সুবিধা অসুবিধার দিকটা তোমরা কেন দেখবে না?
যাইহোক উপায় কিছু নেই। চীরবাসায় ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। কাজেই কপাল ঠুকে গঙ্গোত্রীর পথে নামতে থাকি। মিনিট পনেরোর ভিতরে মাথার উপর মেঘ চলে আসে। তবে বৃষ্টি নয়, শুরু হয় হালকা তুষারপাত। সূক্ষ্ম কাপাস তুলোর মত বরফের কুচি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে নেমে আসে। গায়ে পড়েই মিলিয়ে যায়। বৃষ্টির চেয়ে এ অনেক ভালো। অন্ততঃ ভিজব কম৷
তুষারপাত বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। আধঘণ্টা পরেই আবহাওয়া কিছুটা ভালোর দিকে। নয়ত কপালে দুর্গতি ছিল। তপোবন থেকে গঙ্গোত্রী প্রায় ২৩-২৪ কিলোমিটার পথ। এতখানি দূরত্ব একদিনে হাঁটা, তার উপরে সারাদিনে একবারও ভরপেট খাবার জোটেনি। কাজেই যত বেলা গড়াচ্ছে, শরীরও তত ক্লান্ত হয়ে আসছে। দেওঘাটের সেতু আসতে আসতে শরীর রীতিমত বিধ্বস্ত। দু’পা এগোই, দু-চার মিনিট দাঁড়াই। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবও কমে এসেছে। সত্যি বলতে কী কথা বলতেও ক্লান্তি লাগছে। গঙ্গোত্রী পৌঁছে বিছানায় গা এলিয়ে দিলে তবে শান্তি। মাঝেমধ্যেই পাহাড়ের গায়ে গায়ে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণ। আজ সারাদিনে কত যে ভড়াল দেখেছি! শেষ দলটা গঙ্গোত্রীর একদম দোরগোড়ায়। যাওয়ার দু’দিনে ভড়াল দেখতে না পাওয়ার দুঃখটা এখন আর নেই৷ ভড়াল ছাড়াও আরও এক ধরণের প্রাণী প্রায়শই চোখে পড়ছে। দেখতে বড় ইঁদুর আর খরগোশের মাঝামাঝি। লেজ নেই৷ পাহাড় গায়ে গায়ে, রাস্তার উপরে ছুটে বেড়াচ্ছে। আমাদের দেখতে পেলেই টুক করে লুকিয়ে পড়ছে পাথরের আড়ালে। ওদের নাম পিকা। ইঁদুর গোত্রেরই, তবে ইঁদুর না।
বিকাল সাড়ে চারটায় পৌঁছালাম অমৃতঘাট৷ গঙ্গোত্রী ন্যাশানাল পার্কের চেকপোস্ট। গঙ্গোত্রী আর মাত্র দু’কিলোমিটার। মিনিট পনেরোর মধ্যেই দূরে ভাগিরথীর তীরে দেখা গেল গঙ্গোত্রীর শ্বেতসুন্দর মন্দির। দেখা গেল দু’চারটি পাকা বাড়ি। আর তখনই কী এক আশ্চর্য অনুভূতি এসে মনকে আচ্ছন্ন করল। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল কখন পৌঁছাব গঙ্গোত্রী, কখন ফুরাবে পথ। আর এখন যখন পথ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে তখন মনে হচ্ছে সত্যিই কি চেয়েছিলাম যে পথ ফুরাক। এক বিষণ্ণমধুর পিছুটানে শ্লথ হয় পথচলা। ধূলি ধূসর পথটাকে বড় আপন বলে মনে হয়। যেন কতজন্মের বন্ধন তার সাথে। দেহের শ্রান্তি আর মনের বিষাদের এই যুগলবন্দীতেই এক সময় চলা ফুরায়। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দূর মন্দিরের সুমধুর ঘণ্টাধ্বনি।
সন্ধ্যার মুখে যখন আমরা গঙ্গোত্রী ফিরলাম, তখনও অবধি অখিলেশ বা মুখিয়াজীর কোনো খবর পাইনি। সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর বিধ্বস্ত অবস্থায় তারা ঘরে ফিরল। ব্যাপার কী অখিলেশ?
যেটুকু বিরক্তি ও অভিমান তাদের উপর সারাদিনে জমা হয়েছিল, অখিলেশের কথা শুনে তার সবটুকু মুছে গেল। ঘটনাটা এইরকম –
গোমুখ থেকে আমরা রওনা দেওয়ার পর বড়বাবুর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে মুখিয়াজীর উপরে। রাগের চোটে তিনি মুখিয়াজীকে বলে দেন – তোমাকে আর আমার গাইডের কাজ করতে হবে না। আমি নিজেই ফিরে যেতে পারব। মুখিয়াজী রাগ ভাঙানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। বড়বাবু একাই ভুজবাসার দিকে রওনা হন।
এদিকে ভুজবাসায় পৌঁছে মুখিয়াজী দেখেন রাস্তার পাশেই বসে আছে অখিলেশ। তাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন বড়বাবু তখনও এসে পৌঁছাননি। অথচ তিনি মুখিয়াজীর আগেই পৌঁছে যাওয়ার কথা। সারাটা পথে মুখিয়াজীর সঙ্গেও তাঁর আর দেখা হয়নি। এর অর্থ একটাই। বড়বাবু পথ হারিয়েছেন। গোমুখ পর থেকে প্রায় দু-তিন কিলোমিটার অঞ্চলে নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই। পাহাড়ের গা থেকে নদী পর্যন্ত শুধুই ছোটবড় পাথরের রাজ্য। সবদিক একইরকম দেখতে। তারমধ্যে জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট পাথর সাজিয়ে পথ নির্দেশ দেওয়া আছে। ঠাণ্ডা মাথায় সেগুলোকে দেখে না চললে পথ হারানোর সম্ভাবনা প্রবল।
বড়বাবু যদি পথ হারান, তাঁর গাইড হিসাবে সেই দায় এসে পড়ে মুখিয়াজীর উপর। আর যত দুর্ব্যবহারই পেয়ে থাকুন না কেন, মুখিয়াজী দায়িত্ব এড়ানোর মানুষ নন। অখিলেশকে সঙ্গে নিয়ে আবার চললেন গোমুখের দিকে। কিন্তু বড়বাবুর কোনো চিহ্নই নেই। খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক খোঁজার পর প্রায় নদীর কাছাকাছি এক জায়গায় বড়বাবুকে খুঁজে পাওয়া গেল। পথ হারানোর ভয়ে, একটানা চলার ক্লান্তিতে ততক্ষণে তিনি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। তবু তাঁর তেজ কমেনি। দেখা হতেই মুখিয়াজীকে রে রে করে উঠলেন – একবার গঙ্গোত্রী ফিরি, তোমাদের দু’জনকে আমি পুলিশে দেব।
না, শেষ পর্যন্ত মুখিয়াজীকে পুলিশের ঝামেলায় পড়তে হয়নি। অখিলেশের সহায়তায় সারাদিন ধরে অনেক কসরত করে বড়বাবুকে তিনি নিরাপদেই ফিরিয়ে এনেছেন গঙ্গোত্রীতে। পাওনা টাকা-পয়সাও পেয়ে গিয়েছেন নির্বিবাদে। শেষ ভালো যার সব ভালো।
প্রায় তিনদিন পরে ফোনে নেটওয়ার্ক এসেছে। কাজেই প্রিয়জনদের ফোন করতেই বেশ অনেকটা সময় গেল। মাঝে অভীক সদলবলে এসে দেখা করে গিয়েছে। ওরা আজ বিকালেই গঙ্গোত্রী এসে পৌঁছেছে। কাল ভোরে তপোবনের উদ্দেশে রওনা দেবে। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির মধ্যেই পথের খুঁটিনাটি জেনে নিয়ে গেল। তারপর গরম জলে পা ডুবিয়ে নিরলস বিশ্রাম।
অখিলেশদের বাড়ির সামনেই বিশাল একটি চীর গাছ। রাতে খাওয়ার পর তার নীচে চেয়ার পেতে বসেছি। একা একাই। বেশ ঠাণ্ডা। কিন্তু আগের দু’টো রাত এর চেয়েও ঠাণ্ডায় কাটিয়েছি বলেই হয়ত আজকের ঠাণ্ডাটা বিশেষ গায়ে লাগছে না। রাত হয়েছে। মানুষের কোলাহল থেমেছে। ভাগিরথীর ঝমঝম শব্দে ভরে আছে পাহাড়ে ঘেরা জনপদ গঙ্গোত্রী৷ ভাগিরথীর ওপারে অর্ধেক আকাশ আড়াল করে যে পাহাড়টি দাঁড়িয়ে আছে তার গা বেয়ে নেমে এসেছে আর একটি নদী। কেদারগঙ্গা। ওইদিক দিয়েই চলে গিয়েছে কেদারতালের পথ। অখিলেশ অনেকবার বলেছে – আগলে সাল ফির আইয়ে, একসাথ কেদারতাল যায়েঙ্গে। হেসে বলেছি – দেখা যাক।
আসব বললেই তো আর আসা হয় না। ইচ্ছাটুকু জেগে থাকুক মনে। বাকিটা ভবিষ্যত জানে। হিমালয়কে যতটুকু ভালোবাসতে চেষ্টা করেছি তাতে বুঝেছি যে জেদ করে পাহাড়ে আসা যায় না। পাহাড় যখন ভালোবেসে কাছে ডাকে, তখনই তার কাছে আসা যায়। বুঝেছি আন্তরিক ইচ্ছাটুকু যত্ন করে লালন করলে, পাহাড় কখনও নিরাশ করে না। তপোবন যাত্রা আমার এই দুই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করেছে।
এবারের মত যাত্রা সাঙ্গ হল। যা ছিল কল্পনার গোমুখ, স্বপ্নের তপোবন, তা এখন অপরোক্ষ স্মৃতি। আর স্মৃতি মানেই তা ক্ষয়িষ্ণু। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত স্মৃতি মুছে যাবে। যাপনের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতি নিজের অজান্তেই একটু একটু করে বদলে যাবে প্রতিবার। আজ এই চীর গাছের নীচে বসে চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছি তপোবনের সেই নক্ষত্রখচিত আকাশ, চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত শিবলিঙ্গ। আগামীকালও কি একইভাবে সে দৃশ্য চোখ বুজলেই দেখতে পাব? শুনতে পাব কি ভাগিরথীর এই ছলছল বয়ে চলার শব্দ? যে অচেনা মানুষগুলোর সঙ্গে পথেই আলাপ হল, পথ চলতে চলতে যে চেনা মানুষগুলোর সঙ্গে বন্ধন আরো দৃঢ় হল, হাসি-রাগ-আনন্দ-উদ্বেগের যে অজস্র মুহূর্ত জমা হল তারাও তো অক্ষয় নয়। কে জানে সময়ের স্রোতে ভেসে কোন মানুষ দূরে সরে যাবে, বিস্মৃতির আবরণে কত মুহূর্ত ঢেকে যাবে। তবু অন্তরের অন্তঃস্থলে কোথাও না কোথাও রয়ে যাবে এক টুকরো তপোবন। নিরবধি বয়ে যাবে অন্তঃসলিলা আকাশগঙ্গা।
***
ফুরায় সবকিছু একদিন।
ফুরায় বিষাদ,হাসি,
জীর্ণ ভালোবাসা-বাসি,
নিঃশেষে ফুরায় জীবন।
ব্যথার স্মৃতিও মোছে,
যত রাগ-অনুরাগ,
মোছে জন্মের দাগ,
সময় হারায় আলগোছে।
হারায় যা মন্দ, যা ভালো।
তারপরও কোনো কোণে,
অথবা নিভৃত মনে
রেশটুকু রেখে যায় আলো।অন্তরে জেগে থাকা ওই আলোটুকুই হৃদি গঙ্গার উৎসমুখ। সেখান থেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে বয়ে চলেছে আনন্দ ও বোধের এক অনন্ত ধারা।
(সমাপ্ত)
**********************************
অন্য পথে কেদার (পর্ব ১)
মৈনাক কর্মকার
Traveler, Kolkata
কেদারনাথ মন্দির হিন্দুদের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান। এটি ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের গাড়োয়াল হিমালয় পর্বতশ্রেণীর মন্দাকিনী নদীর তীরে অবস্থিত একটি শিব মন্দির। এখানকার তীব্র শীতের জন্য মন্দিরটি বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া (অক্ষয়তৃতীয়া) থেকে কার্তিক পূর্ণিমা অবধি খোলা থাকে।
কেদারনাথ মন্দিরে যাওয়ার জন্য কোনো সড়কপথ নেই। ২০১৩ সালের ১৪ই জুন কেদারখন্ডে ঘটে যাওয়া প্রলয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগে গৌরীকুণ্ড থেকে ১৪ কিলোমিটার পাহাড়ি চড়াই পথে ট্রেক করে মন্দিরে যেতে হত। লোকের বিশ্বাস, আদি শঙ্করাচার্য বর্তমান স্থানে মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। যদিও মহাভারতেও এই মন্দিরের উল্লেখ আছে। ভারতবর্ষে যে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ আছে, এটি তার একটি জ্যোতির্লিঙ্গ। কথিত আছে, পাণ্ডবরা এখানে তপস্যা করে শিবকে তুষ্ট করেন।
আট কিমি দূরে লিঞ্চোলি, লিঞ্চোলি থেকে কেদারনাথ পাঁচ কিমি অর্থাৎ আগে যেটা চোদ্দ কিমি ছিল বর্তমানে সাড়ে তেইশ কিমি হাটতে হয়। এছাড়াও ঘুত্তু থেকে হাটা শুরু করুন মাওয়ালী পাস ক্রস করে পৌছে যাবেন কেদারনাথ মন্দিরে । আরো একটা ট্রেক রুট আছে বদ্রীনাথ থেকে নীলকন্ঠ পাস ক্রস করুন, পানপাতিয়া গ্লেসিয়ার হয়ে পৌছে যাবেন কেদারনাথ মন্দিরে ।
আমরা একটু অন্য পথে যাবো। শীতকালে কেদারনাথ মন্দিরের মূর্তিগুলিকে ছয় মাসের জন্য ঊখিমঠে নিয়ে গিয়ে পূজা করা হয়। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল কেদারখণ্ড; তাই এখানে শিবকে কেদারনাথ অর্থাৎ কেদারখণ্ডের অধিপতি নামে পূজা করা হয়। ঊখিমঠ ভারতের উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলার একটি ছোট শহর এবং হিন্দু তীর্থস্থান, এটি ১৩১১ মিটার উচ্চতায় এবং রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ৪১ কিমি দূরে অবস্থিত। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, ঊষা(ভানাসুরের কন্যা) এবং অনিরুদ্ধ(ভগবান কৃষ্ণের নাতি) এর বিবাহ এখানে হয়েছিল। ঊষা নামে এই স্থানটির নামকরণ করা হয়েছিল উশমথ, বর্তমানে ঊখিমঠ নামে পরিচিত।
আমরা কথায় কথায় বলি, ” মান্ধাতা আমোল থেকে “! সেই রাজা মান্ধাতা এখানে ভগবান শিবকে তপস্যা করেছিলেন। শীতকালে ভগবান কেদারনাথের উৎসব ডোলি কেদারনাথ থেকে এই স্থানে নিয়ে আসা হয়। ঊখিমঠে রয়েছে আরও অনেক প্রাচীন মন্দির। পবিত্র শহরটি মূলত কেদারনাথের প্রধান পুরোহিতদের রাওয়াল নামে পরিচিত। ঊখিমঠের সাথে কেদারনাথের এক নিবিড় সম্পর্ক আছে, তাই আমরা যাবো ঊখিমঠ থেকে কেদারনাথ।
অন্য পথে কেদার! দুন এক্সপ্রেস ধরে হরিদ্বার, সেখান থেকে বাসে করে পৌঁছলাম ঊখীমঠ। পরদিন সকালে ঊখীমঠ মন্দির দর্শন করে ছোট গাড়ী ধরে রওনা হলাম ১২ কিমি দূরে ওনিওনা গ্রাম | তখন এই পর্যন্তই গাড়ি যেত। এখন রাশি গ্রাম পর্যন্ত গাড়ি চলে যায়। খুব সুন্দর ছোট্ট গ্রাম ওনিওনা, পাহাড়ের ঢালে ঝুম চাষ হওয়ায় দারুন লাগছে দেখতে।
গাড়ি থেকে নেবে হাঁটা শুরু করলাম, দুই ঘন্টার রাস্তা রাশি গ্রাম । আজ থাকবো রাশি গ্রামে। সস্তার একটা ঘর সহজেই পেয়ে গেলাম । গ্রামে বাইরের লোক বলতে শুধু আমরা। দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। শেষে এলাম মন্দিরে। এই মন্দিরের নাম রাকেশ্বরীর মন্দির। পাড়ার মধ্যে ছোট মন্দির। কেউ নেই, শুধুই আমরা! গ্রামের একজন বয়স্ক লোক বললেন জুতো খুলে ঢুকবেন, ব্যস এর থেকে বেশি কোন নিয়ম নেই।
একটা বিশেষত্ব চোখে পরলো, সেটা হল এখানকার যজ্ঞের আগুন কখনো নেবে না। ৬ ইঞ্চি মোটা পাথর দিয়ে ৪ ফুট বাই ৪ ফুটের যজ্ঞের জায়গা। সেখানে একটা মোটা গাছের গুঁড়ি ঢিমে আগুনে ধোঁয়া বেরচ্ছে। তাই মন্দিরের সিলিং কালো হয়ে গেছে। মন্দিরের ভেতর ধোঁয়ায় ভর্তি।
পরদিন সকালে রুটি-আলুর তরকারি খেয়ে বেরিয়ে পরলাম, ঘড়িতে তখন ৮ টা ১০| হাটা শুরু। এই রাশি গ্রামের মানুষ খুব আন্তরিক, একদিনের আলাপ মনেই হল না। যাবার আগে একজন বয়স্ক মহিলা বল্লেন, ” সাবধানে যাবে! “
গ্রাম ছাড়িয়ে বেড়তেই চড়াই শুরু । একটু এগোতে চোখে পরলো দুটো ছোট শিশু নিজের জমিতে চাষ করছে। লাঙ্গল টানার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে ছোট ছেলেটি আর মেয়েটা লাঙ্গল ধরে আছে ,ওরা ভাই-বোন এই জমিতে চাষ করে। ওদের ৪ টে লজেন্স দিয়ে টাটা করে আবার হাঁটা শুরু। বড্ড গরম তার উপর চড়াই রাস্তা | একটা বড় গাছের ছায়ায় সবাই বসলাম । একটু জল, সাথে আড্ডা । আমরা আস্তে হাঁটি তাই আজ খুব বেশী হাঁটাও নেই, চারদিক দেখতে দেখতে যাচ্ছি বড় বড় রডড্রেনড্রন গাছে লাল লাল ফুলে ভরে, কত নাম না জানা পাখি তাদের মিষ্টি ডাক শহর ছেড়ে নির্জনতাকে আরো নিবিড় করে টানে। রাস্তার দুদিকে সবুজ ঘাসের ঢাল, ছোট বড় মাঝারি গাছ সুন্দর করে সাজানো। আবার ঘন্টাখানেক চলার পর সবুজ ঘাসের উপর গরাগরি, মনটা কেমন শিশু-শিশু হয়ে ওঠে! এই ভাবে আড্ডা আর হাঁটা প্রায় ৪ ঘন্টা পর পৌঁছলাম বাজারকোঠি। না আছে বাজার, না আছে কোঠি! তাও যে কে নাম দিল এই জায়গাটার নাম বাজারকোঠি কে জানে!!
তবে ক্যম্প সাইটটা দারুন, সবুজ ঘাসের ঢাল যেন নরম কার্পেট পাতা পিছনে পাহাড় উঠে গেছে বড় বড় গাছ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। চা নিয়ে বসে আলোচনা শুরু হলো | বাজারকোঠিতে জলের খুব অভাব। প্রায় ২ কি.মি. দূর থেকে জল আনতে হল, তাও কাদাগোলা নোংরা জল । কিসে করে জল আনলো জানেন? বড় প্লাষ্টিক ক্যরি ব্যাগ। ঐ জলই ফুটিয় ঠান্ডা করে আমরা খেলাম, আর রান্না হল। রাতে ৮ নাগাদ খেলাম, তারপর আবার আড্ডা দিয়ে ঘুম।
ভোর বেলা ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। টেন্টের বাইরে বেরতেই একটা দারুন দৃশ্য চোখে পরলো। পূর্বদিকে পাহাড়ের পিছন থেকে সূর্যের আলোর ছটা আকাশ জুরে এক কথায় মন ভালো করা সকাল। নিজের সব কিছু গুছিয়ে টেন্ট তুলছি, হঠাৎ চোখে পরলো পাহাড়ী বিছে ঠিক টেন্টের বাঁদিকের কোনে । প্রথমে বুকটা ধরাস করে উঠলেও, পরে দেখলাম সে মৃত।
সব গুছিয়ে বেড়তে ৭ টা বেজে গেল । নীল আকাশ সবুজ পাহাড় বড় বড় গাছে কচি পাতায় রোদ পরে এক অসাধারন দৃশ্য। ভালো লাগলেও বেশিক্ষন বসে উপভোগ করবেন, তার উপায় নেই। আজ অনেকটা পথ হাঁটা । চলার শুরুতেই চড়াই, বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে মিঠে রোদ এসে পরছে আমাদের গায়ে। একটানা চড়াই ওঠার পর ছোট একটা সবুজ মাঠ, তার উপর সরু পায়ে চলা পথ, দু’দিকে পাহাড়ের ঢাল উঠে গেছে। আবার চড়াই উঠতে উঠতে এক সময় পৌঁছলাম কানাড়া খড়ক। বড় একটা পাথরের ওভার হ্যঙ । সেখানেই আমাদের সবাই বিশ্রাম করছে । এক চা বিরতি । এখানে ভেড়াওয়ালা থাকে, তাই জায়গাটা সুন্দর করে পরিস্কার করা ।
৩০ মিঃ-এর বিশ্রাম | আবার চড়াই | তবে এবার পাথরের উপর দিয়ে চলা, একটু এগতে দেখলাম দুদিকে পাথরের দেওয়াল আর তিন ফুট চওড়া পথ। ৪০ ফুট এভাবে চলার পর আবার রডড্রেনড্রনের জঙ্গলে পরলাম। এখানে রডড্রেনড্রন গাছের উচ্চতা ৬ ফুটের মতো। বুঝতে পারলাম অনেকটা উঠে এসেছি। তবে বেশ কিছু বড় বড় চীর গাছ, তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরের বরফ ঢাকা পাহাড়। ঘড়িতে ২:১৫, পৌছলাম পাতুরী।
সরু ছোট একটা রিজের উপর ক্যাম্প সাইট, চারিদিক সবুজ। টেন্ট লাগিয়ে চায়ে মুখ দেব, বৃষ্টি শুরু! সবাই টেন্টে ঢুকে গেল, একটু পর বৃষ্টি থামলো । সবাই বেরিয়ে এলাম, যে যার কাজে লেগে গেল । আজ পরিস্কার জল পেলাম তাই সবাই নিজের নিজের বোতল ভরতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। আমি গেলাম রান্না ঘরে । আজ রাতের মেনু লোভনীয় লুচি আর ছোলার ডাল ।
সন্ধ্যা নাবার আগে পশ্চিম আকাশে আলোর খেলা চলছে কালো মেঘের বুক চীরে আলোর একটা বিম। অনেকটা নাটকের স্পট লাইটের মতো।অনেক গুলো ছবি তুল্লাম । রাত ৮ টা নাগাদ খাওয়া শেষ হল। শেষ পাতে হলদিরামের কাজু বরফি, আহাঃ!
**********************************
কারাকোরাম কন্যা- তুর্তুক
লোপামুদ্রা বর্মন
Traveler, Writer, Photographer
তুর্তুক তুর্তুক……….
ভালোবাসা একবুক……
আদ্যোপান্ত কারাকোরাম পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা, উত্তরপূর্ব লাদাখের সীমান্তের এক গ্রাম। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের থেকে, 1971 সালে সে ভারতভুমিতে পাকাপাকি ভাবে চলে আসে। বালতিস্তানের সংস্কৃতিমাখা। স্কারদু প্রভৃতি পাকিস্তানের জনপদগুলো সীমান্তের ওপারে হলেও, কাছাকাছি। মাঝে অবশ্য সীমান্ত বরাবর কাঁটাতারের ভরা সংসার। চলেছি সেই অপরূপ সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে। নুব্রা থেকে সকল সকাল বেরিয়েছি। পথও খুব কিছু বেশি নয়। বালি, নুড়ি পাথরের ঊষর মরুভূমির বুক চিরে পথ চলে গেছে । ধুধু মরু, মাঝে মাঝে রঙিন ঝোপঝাড়। প্রানের চিহ্ন বলতে ঐটুকুই। না, আরেকজন আছে, শায়ক নদী। কি উচ্ছল, প্রাণবন্ত। রাস্তার ডানদিক দিয়ে বয়ে চলেছে। কখনো একধারা, আবার কখনও বা বহুধারায় বিভক্ত হয়ে। আমরা একই দিকে চলেছি। আমরা তুর্তুকে থেমে যাবো আর ও চলে যাবে সীমান্ত পার করে। এই নদীটি, লাদাখ হিমালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হিমবাহ, শিয়াচেন হিমবাহ অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে, নুব্রা উপত্যকার ভিতর দিয়ে কিছুদূর এসে তুর্তুক ছুঁয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে। সারাপথে, শায়কের এই উচ্ছলতা আনমনা করে দিচ্ছে বারবার। যদিও আমি খুব সজাগ আছি। পাকিস্তান সীমান্ত কাছেই, বলা তো যায় না কখন কি ঘটে। আকাশে হালকা মেঘের ওড়াউড়ি।
পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে সেনাদের গাড়ি চলে যাচ্ছে। শিয়াচেন ওয়ারিয়র্স লেখা পতাকা সারা পথ জুড়ে। এদিকে, আকাশে মেঘের সাথে রোদের লুকোচুরি খেলা বেশ জমে উঠেছে। বোগদাঙ পার করতে করতেই দেখি, মেঘের দল বেশ ভারী হয়ে উঠেছে। সূর্যদেব আর বেরোবার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি, ও হরি, যা ভেবেছি ঠিক তাই। কারাকোরামের উচুঁ উচুঁ পাহাড়গুলোকে পার করে দলে দলে পাকিস্তানি মেঘেরা ভারতের আকাশে ঢুকে পড়ছে, সীমা টিমা কিছুই মানছে না। ভারতের সূর্যকে একা পেয়ে চারদিক থেকে একেবারে ঘিরে ধরেছে। কি সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র করে সূর্যকে ঢেকে ফেলতে চাইছে, সম্পূর্ণভাবে! এইসব দেখতে দেখতেই একটা লোহার বড়ো সেতুর ওপর উঠে পড়লো গাড়ি। জানা গেল, আগে এই সেতুর এপারে ছিল ভারত আর ওপারে পাকিস্তান। এখান থেকে সীমান্তগ্রাম তুর্তুক আরো প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে। দুচোখ ভরে দেখে চলেছি চারপাশের কারাকোরাম পর্বতমালা আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। গাড়ি চলেছে গ্রামের মধ্যে দিয়ে। ছোট ছোট গ্রাম, দোকানপাট। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা অবাকচোখে তাকিয়ে আছে। আরও খানিকটা এগিয়ে এসে গাড়ি থামলো। আমাদের আজকের যাত্রা বিরতি। গাড়ি থেকে সবে নেমেছি, দেখি, বাঁ দিকে থেকে এক অতি চঞ্চল জলধারা, হই হই করে ওপর থেকে নেমে আসছে নীল ঘাগরা উড়িয়ে।তার সরলতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। “আমার নাম তুর্তুক নালা” বলেই সাদা ফেনার উত্তরীয় জড়িয়ে একপাক নেচে নিলো। তারপর একসাথে একরাশ প্রশ্ন, “কে আমি, কোত্থেকে এসেছি, কোথায় যাবো, এতদিন আসিনি কেন”, আরো যেন কি কি। বলি, দাঁড়া, দাঁড়া, এই তো সবে নামলাম। আগে কোমরটা একটু সোজা করে নি। তারপর বলছি। তার কি আর তর সয় ? দিলো দৌড়।
ভালো করে চারপাশটা দেখি। এই নালাটার উপরে দুটো সেতু আছে, একটা কাঠের অপরটা কংক্রিটের। গ্রামটা বেশ ছড়ানো, নদী, সেতুর কোলে পিঠে চড়ে ক্রমশঃ নিচ থেকে ওপর দিকে উঠে গেছে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, গ্রামের ওপর দিকের অংশে।
পিঠে ব্যাগ নিয়ে এক সরু জলধারার পাশে পাশে উঠে চলেছি ওপরের দিকে। খানিক ওঠার পর সমান সমান রাস্তা। কংক্রিটে বাঁধানো। দুধারে আলুর ক্ষেত, পাহাড়ি বিনস, রাজমার লতায় বেগুনি ফুল হাওয়ায় দুলছে।
হলুদে-সবুজেমাখা বার্লির ক্ষেত, চোখ দুটিকে টেনে রেখেছে যেন। ক্ষেতের শেষ মাথায় পাথরের বাড়ি। নকশায় নতুনত্ব। ফসলের জমিগুলো গড়াতে গড়াতে পাহাড়ের পায়ের পাতা ছুঁয়েছে। সেখানে লম্বা লম্বা উইলো গাছগুলো দুলেই চলেছে। অনেক উঁচুতে পাহাড়ের মাথা ছুঁয়ে বাবরি চুলের মতো মেঘগুলো রাগী মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এসে পড়লাম অতিথিশালার সামনে। বাড়িটাতো দেখাই যাচ্ছে না। চেরী আর ঝাঁকড়া এপ্রিকটের ছায়ায় বেশ তপোবনের অনুভূতি। কিছু চেরী পেকে আছে, লাল টুকটুকে। মালিক মানুষটি মিশুকে, অমায়িক। এককাপ চা খাওয়ার ফাঁকে জেনে নিলাম কি কি দেখার আছে। একটি ছেলেকে সঙ্গে দিয়ে দিলেন।
গ্রামের মধ্যে দিয়ে পথ। খানিক চলার পর একটা দেয়ালে লেখা আছে দেখি, Natural Cold Storage, ছেলেটি জানায় এই ঘরগুলো আসলে গরমকালের জন্য প্রাকৃতিক বাতানুকূল ব্যবস্থা। ঘরগুলোতে একটা করে ছোটো দরজা আছে। সেই দরজাটা খোলার সাথে সাথেই ফ্রিজের দরজা খোলার মতো ঠাণ্ডাঝলক। এব্যবস্থা আমি আগে কোথাও দেখিনি।
প্রত্যন্ত পাহাড়ের আড়ালের এক ছোট্ট গ্রামে এমন আধুনিক ব্যবস্থা, সত্যিই অবাক করার মতো।এ ইসব ভাবতে ভাবতে হেঁটে চলেছি। উইলো, পপলারের ছায়ায় ছায়ায় পথ। এসে পড়েছি গ্রামের শেষ মাথায়। সামনে এক চড়াই পথের নিশানা। ছেলেটি বলে, ওই পথেই যেতে হবে। ওপরে একটা বৌদ্ধ গুম্ফা আছে। অল্প কিন্তু একটানা চড়াইপথে উঠে আসি গুম্ফায়।
গুম্ফা বলতে একটা ছোট্ট ঘর, ভিতরে ধুপ জ্বালানো। চাতাল জুড়ে লুংদার হাওয়ায় উড়ছে। ছেলেটির থেকে জানতে পারি, এটা ছিল আসলে পাকিস্তানি সৈন্যদের বাঙ্কার। 1971 সালে এই অঞ্চল ভারতের অধীনে চলে আসার পরে লাদাখি সৈন্যরা বাঙ্কারের সামনের অংশটিতে গুম্ফাটি তৈরি করে। পিছনের অংশে পরিত্যক্ত বাঙ্কারটি এখনও অক্ষত অবস্থায় আছে।
বাঙ্কার টিকে ভালো করে দেখি। লোহার বাক্স দিয়ে তৈরি, চারদিকের দেওয়াল। আর মাথার ওপর ফৌজি ছাউনি। ওপর থেকে সম্পূর্ণ উপত্যকাটি বেশ পরিষ্কার নজরে আসে। আর দেখা যাচ্ছে শায়কের বিস্তার। বহুধারায় বিভক্ত হয়ে আপন মনে বয়ে চলেছে পাকিস্তান সীমান্তের দিকে। কোথা থেকে একটুখানি হিংসে এসে মনকে চিমটি কাটলো, ইস, আমিও যদি ঐরকম যেতে পারতাম! হঠাৎই চোখ চলে যায় আকাশের দিকে।
আরিববাস, এই না হলে ভারতীয় হাওয়া! সব পাকিস্তানি মেঘের দলকে উড়িয়ে ভারতের সীমানা পার করাচ্ছে! মেঘগুলো কেমন ভয়ে কারাকোরামশ্রেণীর ওপর দিয়ে পালাচ্ছে, উঃ, কি রোমাঞ্চকর দৃশ্য! ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। সূর্যদেব হাঁফ ছাড়লেন। সারা উপত্যকা সোনার আলো মেখে ঝলমলিয়ে উঠলো। কানায় কানায় ভরে ওঠা মন নিয়ে ফেরার পথে ধরলাম। আরেকটা আশ্চর্য জিনিস দেখা বাকি আছে। উৎরাই পথে নামতে নামতে ছেলেটি এই গল্পের রেশ ধরে কত কথা বলে যাচ্ছিলো। কথাগুলো বাড়িতে বড়োদের কাছে শুনেছে। 1971 সালের সেই বিশেষ দিনটিতে ভারতীয় সেনারা এসেছিলো। সবার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করেছিলো। একসাথে নামাজ পড়েছিল। গ্রামের সকলে খুব শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো রাতে। শুধু গ্রামের কিছু মানুষ যারা নাকি কয়েকদিন আগে কাজের প্রয়োজনে স্কারদু বা অন্য কোনো শহরে গিয়েছিলো, তারা আর কোনোদিন ফিরে আসতে পারেনি নিজের গ্রামে, কারণ আস্ত সেই গ্রামটাই তো দেশান্তরী হয়ে গিয়েছিলো। সেই মানুষগুলো যারা পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে কাজ করতে গিয়েছিলো, একরাত্রেই তারা ভিনদেশি হয়ে গিয়েছিল। চিরকালের জন্য মা হারিয়েছিলেন সন্তানকে, সন্তান হারিয়েছিল পিতাকে।
এইসব শুনতে শুনতে আমার গলার কাছে কি যেন একটা এসে আটকে গেলো। ছেলেটির উদাস দৃষ্টি তখন আটকে আছে দূর পাহাড়ের কোনো অজানা ঢালে। হয়তো ওই পাহাড়ের কোলে কোনো নাম না জানা গ্রামে তার কোনো আপন জনের ঘর আছে। সেও বুঝি এই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে একই কথা ভাবছে।
একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। এটা একটা জাদুঘর। পারিবারিক সম্পত্তি। এখন যাঁরা রয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে তাঁদের পূর্বপুরুষ সূত্রে পাওয়া সব জিনিস। বালতিস্তানের নিজস্ব সংস্কৃতি। তারমধ্যে চকমকি পাথরও আছে। এমনকি বিবাহের টুপিটি পর্যন্ত আছে।
ভাগ্যিস এসেছিলাম, না হলে এত কিছু অজানাই থেকে যেতো। শহুরে কুয়োর ব্যাঙের ভাগ্যে কি অসাধারণ সিকে ছেঁড়া, যেন অলিবাবার এক আস্ত গুহা।
রাতে মেঘহীন তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘগুলো জন্য বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। ভিতর থেকে কেউ যেন বলে উঠলো, মেঘগুলো এই মানুষগুলোর জমাট বাঁধা অশেষ দুঃখ। যখন ঝরে পড়ে শায়ক উপত্যকায়, শায়ক তাকে বুকে নিয়ে ছুটে যায় ভৌগোলিক সীমানা পার করে। অথবা হয়তো মেঘপিওন। এপারের খবর ওপারে নিয়ে যায়, ওপারের খবর নিয়ে আসে এপারে। কি জানি।
স্মৃতি খুঁড়ে এইসব লিখছি আর ব্যথায় ভরে উঠছে মন…………….
**********************************
স্বর্গোদ্যানের পথে – The Valley of Flowers
Shankha Sanyal
Traveler, Kolkata
“…Others will visit it, analyse it and probe it but, whatever their opinions, to me it will remain the Valley of Flowers, a valley of peace and perfect beauty where the human spirit may find repose.” .. Frank Smythe, 1931
১৯৩১ সালের বর্ষাকাল, ৬ জনের ব্রিটিশ অভিযাত্রীদল, কামেট পর্বত অভিযান সমাপ্ত করে ধৌলি আর অলকানন্দা উপত্যকা অতিক্রম করে ফেরার পথে হাজির হল ভুইন্দার পাসে… মেঘের সারি তখন আকাশ থেকে নেমে হাতের নাগালে, ভুইন্দার উপত্যকা তখন শুধুই মেঘের রাজ্য, দিশাহারা যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়িয়ে নামল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, ১৭০০০ ফিট উচ্চতায় ঠকঠক করে কাঁপছে তখন সবাই, এমন সময় এক অভিযাত্রী হোল্ডসওয়ারথ পাশের জন স্মাইয়থকে ঝাঁকিয়ে ধরে বলল “ওই দ্যাখো!”… হোল্ডসওয়ারথের দৃষ্টি অনুসরণ করে স্মাইয়থ দেখতে পেল বৃষ্টির দাপটে আস্তে আস্তে মেঘ সরে যাচ্ছে, ১৭০০০ ফিট উচ্চতায় তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন দিগন্ত-বিস্তৃত হলুদ, নীল, গোলাপি, লাল হরেক ফুলের বাগানের মাঝে! যেদিকে দু-চোখ যাচ্ছে হরেক বাহারি ফুল, জনমানবহীন হিমালয়ের এই সুউচ্চ প্রান্তরে কে লাগাল এত ফুলের গাছ, কেই বা করে পরিচর্যা! চারিদিকে তুষারাবৃত শৃঙ্গ আর তার মাঝে মাইলের পর মাইল চোখ ধাঁধানো সবুজের প্রান্তরে ফুলের বাহার, বিস্ময়ে অভিভূত স্মাইয়থের মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল “The Valley of Flowers”!!
কাট টু ২০০৫ সাল, পুষ্পবতী নদীর পাশ দিয়ে ১০০ বর্গ কিমি বিস্তৃত এই উপত্যকা পেল UNESCO World Heritage Site-এর তকমা, বিশ্বের দরবারে পৌঁছে গেল হিমালয়ের প্রত্যন্ত কোলে লুকিয়ে থাকা এই অবাক বিস্ময়! শয়ে শয়ে ভ্রমণ-পিপাসু মানুষ বিপদসংকুল দুর্গম পথ অতিক্রম করে পৌছতে লাগলো প্রকৃতির এই অনাবিল সম্পদের সৌন্দর্য নিতে, কিছু দিনের জন্য ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা, দীনতা, দুঃখ ভুলে হারিয়ে যেতে বিস্ময়ের সমুদ্রে… আমাদের এবারের গন্তব্য উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার অন্তর্গত ঘাঙ্গারিয়া থেকে ৫ কিমি দুরের “ফুলো কা ঘাঁটি” বা Valley of Flowers!
হরিদ্বারের গোলযোগ, কিচির মিচির থেকে ২৬০ কিমি দূরে বদ্রি বিশালের ৩০ কিমি আগে ছোট্ট জনপদ গোবিন্দঘাট – ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস/ হেমকুন্ড সাহিব যাত্রা শুরু হয় এখান থেকেই! পেল্লায় এক গুরুদ্বারায় শয়ে শয়ে লোকের বিনামূল্যে থাকা আর লঙ্গরে পেট পুরে খাওয়ার ব্যবস্থা! একটু দূরেই প্রবল পরাক্রমশালী অলকানন্দার সাথে মিশেছে লক্ষ্মণ গঙ্গা নদী, সব মিলিয়ে ধর্মপ্রাণ শিখদের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এক প্রাণবন্ত পাহাড়িয়া জনপদ! আগে এখান থেকেই ১৪ কিমি হাঁটা রাস্তায় পড়ত ঘাঙ্গারিয়া, এখন পিচ রাস্তায় আরও ৪ কিমি এগিয়ে যাওয়া যায় পুলনা গ্রাম অবধি, সেখান থেকে অতঃপর ১০ কিমি পরে ঘাঙ্গারিয়া/গোবিন্দধাম! প্রথম ৬ কিমি রাস্তা অল্প চড়াই, পথের ধারে অজস্র ঝর্না, ভরা বর্ষায় তারা সবেগে আছড়ে পড়ছে খাড়াই পাহাড়ের মাথা থেকে; রাস্তায় পড়বে অজস্র ছোট দোকান, শিখদের লঙ্গর, আর প্রচুর হাসিমুখ ৮ থেকে ৮০ হেমকুন্ড সাহিব যাত্রী, যারা সবাইকে কখনও গ্লুকন ডি, কখনও বিবিধ টফি বিলোতে বিলোতে, খালি পায়ে ওয়াহে গুরুর নাম গান করতে করতে হেমকুন্ড সাহিবের দুর্গম রাস্তায় এগিয়ে চলেছে! পথের প্রান্তে তীর্থ তো আমাদের সত্যিই নয়, পথের ধারেই আমাদের দেবালয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে!
ভুইন্দার গ্রামে লক্ষ্মণ গঙ্গা নদীর কাঠের পুল পেড়িয়ে শুরু হয় খাড়া চড়াই, শেষ ৩ কিমি পেরোতেই লেগে যায় আড়াই তিন ঘণ্টা, তারপরে আসে গোবিন্দধাম/ ঘাঙ্গারিয়া – ভ্যালির বেস পয়েন্ট! গোটা দশেক হোটেল, এক বিশাল গুরুদ্বার, একটা ফরেস্ট অফিস, একটা পুলিস চৌকি আর একটু দূরে হেলিপ্যাড, সংক্ষেপে এই হলো ছবির মতো গ্রাম ঘাঙ্গারিয়া! বছরের ৮ মাস বরফের তলায় থাকার পরে জুন মাসে ৫-৬ ফিট বরফ সরিয়ে চালু হয় এখানকার রোজনামচা! সাথে রয়েছে খামখেয়ালি বৃষ্টি, চায়ের দোকানের মালিক যশপাল রানার কথায় “বোম্বাই কা ফ্যাশন, ঔর ইহা কা মৌসম, কব বদল জায়ে, কোই ঠিকানা নেহিন”! আমরা পুলনা থেকে রওনা দিলাম মৃদুমন্দ বৃষ্টি নিয়ে, ৩০ টাকায় কেনা পঞ্চো-তে মুড়ে নিজেদের, যতক্ষণে ঘাঙ্গারিয়া পৌঁছলাম, সেই মৃদুমন্দ বৃষ্টি চারিদিক থেকে ধেয়ে আসা উলম্ব মেঘের সৌজন্যে রীতিমত বারিধারায় পরিণত হয়ে আমাদের সকলকে ভিজিয়ে পাটিসাপটা বানিয়ে দিয়েছে! ঘাঙ্গারিয়া পৌঁছে প্রথম জানলাম যে কাপড়, জুতো ইত্যাদি শুকানো একটা সংগঠিত ব্যাবসা হতে পারে, পার জামা ৫০ টাকা, মোটা জ্যাকেট/জুতো হলে ১০০ টাকা! এছাড়াও সব হোটেলের তলায় তেল মালিশ আর ম্যাসাজ পার্লার! কথায় বলে না Necessity is the mother of Invention!
টিপ টিপ বৃষ্টি, মেঘের গর্জন আর ঘোড়ার ক্ষুরের ঠকঠক শুনতে শুনতে রাতটুকু জিরিয়ে নিন, পরদিন সকালে আবার ৪ কিমি মতো গেলে পৌঁছে যাবেন ফুলের সাম্রাজ্যে-স্বর্গোদ্যানে! পথে পড়বে গোটা দুই গ্লেসিয়ার, পুষ্পবতী নদীর যাত্রাপথ!
“I will lift up mine eyes unto the hills
from whence cometh my help..”
আমি চোখ মেলে চাইবো পাহাড়ের দিকে, পাহাড় ভুলিয়ে দেবে আমার সব মলিনতা, ক্লেদ! বাইবেলের ১২১ তম সামসঙ্গীত! চোখের সামনে সত্যি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক কবরের ওপরে পাথরের স্মৃতিফলক হয়ে! জো মার্গারেট লেগি – ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী, ভারতের ফুল নিয়ে গবেষণা এসেছিলেন সেই ১৯৩০-এর দশকে, মুগ্ধ হয়েছিলেন ভুইন্দার উপত্যকার এই বিস্ময়ে, আপন খেয়ালে ঘুরে দেখছিলেন ভ্যালীর আনাচ কানাচ, হঠাৎ ছন্দপতন! হিমালয় নির্দয়, মুহূর্তের অন্যমনস্কতা ডেকে আনল বিপদ, পাহাড়ের খাঁজ থেকে কয়েকশো ফুট নীচে পতন – ভ্যালীর গহীনে আজও নিশ্চিন্তে আকাশ-চুম্বী হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন ম্যাডাম লেগি। আমাদের মতো পথ ভোলা অল্প কিছু অভাগা হাঁপাতে হাঁপাতে আজও পৌছয় সেই কবরের কাছে, মেঘ মল্লারের চাঁদোয়া হয় সেখানে যখন তখন, আশপাশের তুলো গাছের রোঁয়া পুষ্পবৃষ্টি হয়ে অভ্যর্থনা জানায় শ্রান্ত পথিককে, জংলি লাল ফুল আপন খেয়ালে বানিয়ে দেয় রেড কার্পেট, চারপাশের বরফাচ্ছাদিত হিমালয়ের শৃঙ্গগুলি জানায় কুর্ণিশ – সেই কোন মুলুক থেকে এসে হিমালয়ের কোলে আশ্রয় পেয়েছেন ম্যাডাম লেগি, এখানেই তো লেখা হয়েছিল অতিথি দেবঃ ভবঃ। আট মাস বরফের চাদরের তলায়, আর চার মাস ধরে প্রকৃতির আপন খেয়ালি রঙ-বেরঙের ম্যাজিক – আহা সবাই যদি এমন শয্যা পেত! আজ শোনাবো UNESCO-র তালিকায় ঠাঁই করে নেওয়া ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস বা ফুলো কা ঘাঁটির গপ্পো!
ঘাঙ্গারিয়া থেকেই শুরু খাড়াই রাস্তা – এক কিমি পরেই রাস্তা দু-ভাগ – আপনার আশেপাশের যত ভিড় সবাই সোজা চলেছে, একটু হকচকিয়ে বাঁ দিকের ভাঙ্গাচোরা রাস্তাটায় ঢুকলেই দেখবেন সব চুপ করে গেছে কেমন, শুধু নিচ দিয়ে বিপুল স্রোতে বয়ে চলেছে লক্ষ্মণ গঙ্গা নদী। হ্যাঁ সাইন বোর্ডে ঠিকই লেখা ছিল, এই হল ভ্যালীর রাস্তা, আর ফেলে আসা সোজা রাস্তাটা চলে গেছে হেমকুন্ড সাহিবের পথে। খানিক দূর গেলেই পড়বে চেক পোস্ট, ১৫০ টাকা দিয়ে তিন দিনের পারমিট করিয়ে এগিয়ে চলুন পাথুরে রাস্তা ধরে। খেয়াল রাখবেন এই চেক পোস্ট খোলে সকাল ৭টায়, বন্ধ হয় ১২টায়, এ পথে খাবার কোনও দোকান নেই, তাই ভালো করে ঘুরতে চাইলে জলের বোতল আর দুপুরের খাবার প্যাক করে নেবেন। ১ কিমি মতো চলবে অল্প চড়াইের রাস্তা – এই পথেই চোখে পড়বে কোবরা লিলি, ব্লু পপি ও আরও নানান রকমারি ফুল, তারপরেই আসবে লক্ষ্মণ গঙ্গা নদীর ওপর একটি লোহার পুল। এই পুলের পরের ২ কিমি হচ্ছে এক ভয়ংকর চড়াই, কিছু কিছু জায়গায় রাস্তা উঠেছে প্রায় ৬০ ডিগ্রী কোণে। এরকমই একটা বাঁক থেকে অনেক দূরে প্রথম দেখা যাবে ভ্যালীর দৃশ্য! সে এক অপরূপ দৃশ্যপট – মাইলের পর মাইল চোখ ধাঁধানো সবুজ আর তার ওপরে কোথাও হলুদ, কোথাও বাদামী কোথাও ফ্যাকাশে সাদা রঙের ছোপ – ঠিক যেন কোনও শিল্পী আপন খেয়ালে ক্যানভাসে তুলির ছোপ টেনেছে! বহু বার দেখেছি, হিমালয়ের বাঁকে বাঁকে এই দৃশ্য যেন টনিকের কাজ করে, ধুঁকতে থাকা লোকজন আবার দূরকে নিকট করার তাগিদে নতুন উদ্যমে চলতে শুরু করে… “হে দূর হইতে দূর, হে নিকটতম,. যেথায় নিকটে তুমি সেথা তুমি মম,. যেথায় সুদূরে তুমি সেথা আমি তব”।
২ কিমি খাড়া চড়াইয়ের শেষে এক গ্লেসিয়ার, সেইটে পার হলেই পড়বে পুষ্পবতী নদীর ওপরে কাঠের পুল – ভ্যালীর সীমানা শুরু, চোখ ভরে দেখা আর বুক ভরে Vitamin H নেবার পালা শুরু! কিন্তু গ্লেসিয়ারের মুখেই বিপত্তি, আগের রাতের ধ্বসে রাস্তা ভেঙে চৌচির, সরু এক ফালি যেটুকু পড়ে আছে, আমরা কোনও মতে পেরলেও দলের বয়স্করা পেরবেন কেমন করে! ভাবছি কি করা যায়, ওমা হঠাৎ দেখি পাহাড়ের খাদ থেকে ২ জোড়া হাত বেড়িয়ে এল “আইয়ে সাব হাত দিজিয়ে, চিন্তা মত কিজিয়ে, হামলোগ হ্যায় না!”, ও বাবা দুটি ২০-২২ বছরের ছেলে খাদের দিকে নেমে রাস্তা সারাচ্ছে, আর পরোপকারটা? ভলেন্টারি সার্ভিস, কোনও রুল বুকে পাবেন না! আমাদের দলের প্রত্যেক-কে হাত ধরে ভাঙা জায়গাটা পার করিয়েই আবার ওরা লেগে পড়ল নিজেদের কাজে, রাস্তা বানাতে হবে তো!
“In Garhwal I found no red, green or black shirts, no flags or emblems, no mechanisms, no motor-cars or aeroplanes, but I did find happy and contented people. I think the attitude of Himalayan peoples to western progress is best summed up in the words of a Tibetan, and Tibetans consider themselves superior to Europeans in spiritual culture. He said: “We do not want your civilisation in Tibet, for wherever it is established it brings unhappiness and war.” It is a terrible indictment and it is true.” … … Frank Smythe, 1931
প্রায় ১০০ বছর পরেও গাড়োয়াল আছে গাড়য়ালেই, ভাগ্যিস!
গ্লেসিয়ার পেড়িয়ে পুষ্পবতী নদীর নড়বড়ে পুল পেরলেই দেখবেন পাথরে লেখা, ভ্যালি শুরু হলো… এরপরে শুধুই ম্যাজিক… দুপাশে কখনও সাদার ওপরে বাদামী ছিট ছিট ফুল, কখনও আকাশি রঙের বাহার, কখনও বা আমাদের সবার পছন্দের খয়েরি ফুল, নাম তো কোনওটারই জানিনা, ঘাঙ্গারিয়াতে একদিন ডকুমেন্টারি দেখে কি আর সব নাম মনে রাখা সম্ভব নাকি! তবু অবাক হতে তো বাধা নেই, আর না হয়েও উপায় নেই, প্রতি ১০০ মিটার অন্তর রয়েছে নতুন বিস্ময়। মৌমাছিরা ঘুরে ঘুরে ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে, মাকড়শা জাল বুনে রেখেছে নানান জায়গায়, মধ্যে মধ্যে সূর্যের আলো পড়ে সে জালের কি ছটা, পাথুরে রাস্তার ওপরে তাকালেই গ্লেসিয়ার – ঠিক যেন Alice in Wonderland! একটু খেয়াল করে এদিক ওদিক তাকালেই চোখে পড়বে ব্রহ্মকমল – স্বর্গের ফুল! লালমোহন বাবু থাকলে ফেলুদাকে ঠিক বলতেন, এ কোথায় এলাম মশায়, এ তো স্বর্গ, রাখুন আপনার তাত্ত্বিক কথা, আসুন বৈকুণ্ঠ মল্লিকের একটা কবিতা শোনাই, এই পোড়া দেশে লোকটা কদর পেল না!
ভ্যালীর মধ্যে ১ কিমি মতো যাবার পরেই দেখলাম সবাই মুগ্ধ হয়ে একেক দিকে বসে পড়ছে খাবার হাতে, কিন্তু আমায় যে টানছিল “লেগিস’ গ্রেভ” আর তাকে ঘিরে হরেক মিথ, তাই খিদে পেটেই চলতে থাকলাম, সময় যে বেশি নেই, বেলা ২টোর মধ্যে ফেরা শুরু করতেই হবে। একসময় দেখলাম রাস্তা এমনই শুরু হয়ে গেছে দু’জন পাশাপাশি চলতে পারবে না, আর এ রাস্তায় লোক এতই কম যে রাস্তার ওপরেই ফুটে আছে হরেক জংলি ফুল, প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের ডালি উপুর করে দিয়েছে, কারও ভাগ কম না, কেউ ছোট না এই মুলুকে! প্রায় ৩ কিমি পরে, একটা গ্লেসিয়ার গড়িয়ে পার হয়ে, একটা প্রবল পরাক্রমী ঝর্না পার করে এল সেই জায়গা – লেগিস গ্রেভ – সময় এখানে থমকে দাঁড়িয়ে, ২০১৩ র হড়পা বান হোক, কি ২০১৯-র চন্দ্রযান, এখানে কিচ্ছু স্পর্শ করে না – এখানে হিমালয় রাজা, আর প্রজারা সবাই থাকে অপার শান্তিতে! চুপ করে বসে থাকুন এখানে খানিকক্ষণ, ফার্ন গাছের হাওয়ার শব্দ শুনুন, ওই দূরের পাহাড়ের ঝর্ণার গর্জন শুনুন, আপনি ভাগ্যবান, এই রাজ্যে প্রবেশ করেছেন, নামতে তো হবেই আবার সবাইকে!
তো বেশ ভাব এসেছে, বসে আছি, হঠাৎ ওপর থেকে চীৎকার ভেসে এলঃ “ইয়ার্কি হচ্ছে, তাড়াতাড়ি উঠে আয়, ফিরতে হবে, বৃষ্টি নেমে গেছে”। বুঝলাম যাদবপুর ইউ.কে-তেও পিছু ছাড়ে না! খেয়াল করলাম আশেপাশে দু’হাত দূরের জিনিস দেখতে পাচ্ছি না, ২টো বেজে গেছে, পাহাড়ে মেঘ নামার সময় হয়ে গেছে! ছুট ছুট, ইতিমধ্যেই নামলো টিপ-টিপ থেকে ঝমঝমে বৃষ্টি, গ্লেসিয়ার পেড়িয়ে হু হু করে নামছি যখন কি একটা খটকা লাগল! ফট করে মনে পড়ল, আরে সেই ভাঙা রাস্তাটা? গ্লেসিয়ার টা দিয়েও তো দিব্যি পেড়িয়ে এলাম! এই ২-৩ ঘণ্টায় সেই রাস্তা আবার আগের জায়গায়, শুধু তাই নয় ওই দুই ছোকরা গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়েও রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে! যতক্ষণে আমরা চেকপোস্টে এলাম ততক্ষণে ভিজে চান, দেখলাম ওই বৃষ্টির মধ্যে ফরেস্টের লোকেরা প্রস্তুতি নিচ্ছে আমাদের খোঁজ নিতে যাবার, ঘড়ির কাঁটা যে তখন ৫টা ছুঁই ছুঁই!
“In Garhwal I met a true civilisation, for I found contentment and happiness. I saw a life that is not enslaved by the time-factor that is not obsessed by the idea that happiness is dependent on money and materials. I had never before realised until I camped in the Valley of Flowers how much happiness there is in simple living and simple things.” Frank Smythe, 1931
**********************************
Mountains in Illustration
Abhinanda Chowdhury
Research Scholar, Indian Association for the Cultivation of Science, Kolkata
**********************************
Tales from Wild: Common Tailorbird
Soumyo Chatterjee
Research Associate, School of Physical Sciences, Indian Association for the Cultivation of Science, Kolkata.
Common tailorbirds, popularly known as ″Tuntuni″ in West Bengal, are small, brightly coloured songbirds typically found throughout the Indian subcontinent and tropical Asia. Named after their unique nest making skills, tailorbirds are actually considered as Warblers and they belong to the family of two other very common grassland birds, Prinia and Cisticola.
Common tailorbirds, alike their thirteen sister tailorbird species, possess a brightly coloured plumage with a rufous-coloured crown on head, vibrant olive-green upperparts and a relatively paler, cream coloured underpart with pinkish legs. Their face is white in colour with pale brown eyes and a long, down curved sharp bill; on the neck there are some dark patches. Their wings are short, rounded and suitable for constantly shifting their perch by making short, quick darting flights. The tail of a common tailorbird is typically short but in breeding plumage, the central tail feathers of a male grow longer. Apart from this special tail feathers, the sexes in common tailorbird look identical however the juveniles are a bit dull in colour than the adults.
Like most warblers, common tailorbirds are insectivorous. They are often found very restlessly foraging and hopping into vegetation of forests, scrub lands, mangroves, open woodlands and even in urban parks or gardens in search for insects like beetles and bugs. They are also known to consume small fruits, berries, sip some nectar or eat tiny seeds. Common tailorbirds are therefore a common sighting near flowers like Bombax or Salmalia.
The breeding season for common tailorbirds usually coincides with monsoon in India and principally spans from June to August. As their name suggests, the most interesting part of a tailorbird’s breeding is their unique style of making the nest. Their nests are usually low, at about one metre above the ground and built by folding and stitching a large leaf or a few leaves. After a pair is formed, the process is typically carried out solely by a female bird in the morning or late afternoon, and spans over a course of two to four days. She, at first, carefully selects a broad, strong, supple leaf which can provide good structural support once folded. The female checks the size of the leaf by wrapping it around herself and if found smaller, she adds another one or two leaves to make it of the right size. Usually, the leaves at the end of a branch and within thick foliage are chosen to reduce the possibility of a predator invasion. She then uses her feet to pull the leaf together and pierces a series of tiny holes along the leaf’s edge using her long needle like beak. Plant fibres (such as cotton or lint) or silk from insects (such as cobwebs or caterpillar cocoons) are then threaded through the holes to make a cradle in which the actual nest is built. A typical tailorbird nest contains around 200 stitches that hold the leaf edges together like rivets and make a cup-like shape. Such a shape actually follows the natural look of the plant and since, the upper, shinier surface of the leaf faces outwards, and so, a tailorbird nest is really difficult to spot. To protect the nest from monsoon rains or scorching heat of the Sun, one or more pieces of leaves are pulled down and stitched together to make a roof. This also secures and conceals the nest from predators.
Although the stitching part of a nest making is solely done by a female bird, the male contributes to the process by supplying nesting materials such as threads and after the “cup” is made, it is the male who collects soft natural materials like feathers, animal hairs or fine grass and fills the cup to insulate the inner environment. The female usually lays 2 to 5 pastel blue colored eggs, speckled with brown and once hatched, the chicks are raised by both the parents. The young birds leave the nest after around three weeks and after that the nest is abandoned. Such abandoned nests are often picked apart and reused by another common tailorbird couple. Sometimes, the tailorbird nests are parasitized by the Plaintive Cuckoo, a widespread brood parasite in Asia.
Since, the common tailor birds are well adapted to human habitation and are one of our most common backyard birds; they have often been featured in literatures. A very famous example in this direction is English poet Rudyard Kipling’s Jungle Book where a tailorbird couple ′Darzee′ and his wife have been the characters. In Bengali literature, the classic book titled “Tuntunir Boi” by Upendrakishore Raychowdhury also illustrates the wise and intelligent behaviour of this bird species. Recognizing their integral relationship with tailorbirds several Asian countries have featured different species of tailorbirds in their postal stamps.
Luckily, common tailorbirds are currently well away from the threshold for being threatened. Their population and range size are so far listed as ′Least Concern′ in the IUCN list however with habitat degradation and fragmentation issues on the rise this species will sooner or later face the threat surely. We must remember that we are passing through an age during which more and more bird species are threatened with extinction every day, so, these winged beauties essentially need our attention and care to survive. So, pick up your gadgets, get out on the field and don’t miss to admire the skill of a common tailorbird. Happy birding..
Different species of Tailorbirds featured in postal stamps
Resources:
1. Collins Field Guide, “Birds of India, Pakistan, Nepal, Bhutan, Bangladesh and Sri Lanka” (2015).
2. Ajay Hom, “Banglar Pakhi” (2015)
3. Pranabesh Sanyal & Biswajit Roychowdhury, “Paschimbanglar Pakhi” (1994)
4. Salim Ali and Ripley Dillon, “Handbook of the Birds of India and Pakistan: Vol 4” (1987).
*******************************